ছলিম উদ্দিন (৮৯) রাখাইন প্রদেশের আকিয়াবের নিজ এলাকায় দুইবার ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান এবং তিনবার উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ছিলেন। তার চার স্ত্রী, সন্তান ২৬ জন। তাদের মধ্যে ১৪ ছেলে, ১২ মেয়ে। নাতি ৪৭ জন, নাতনি ৩৪। ছেলেদের মধ্যে দুজন অস্ট্রেলিয়া, পাঁচজন সৌদি আরবে থাকেন।
মেয়েদের মধ্যে চারজন আছেন সৌদি আরব। তারা সেইসব দেশে বিয়ে করেছেন। ছলিম উদ্দিন পরিবারের অবশিষ্ট সদস্যদের নিয়ে বর্তমানে উখিয়ার থাইনখালি রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে আশ্রয়ে আছেন। সম্প্রতি প্রথম স্ত্রী মারা গেছেন। পরবাসে থাকায় তিনি আর নতুন করে বিয়ের কথা ভাবছেন না বলে স্বজনদের জানিয়ে দিয়েছেন।
ছলিম উদ্দিনের একার পরিবারই কেবল বড় নয়। বরং মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা পরিবারগুলোর একজন উত্তম উদাহরণ ছলিম উদ্দিন। শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের (আরআরআরসি) কর্মকর্তারা বলেছেন, রোহিঙ্গা জনবিস্ফোরণ বন্ধ করা প্রায় অসম্ভব। গত তিনবছরে টানা চেষ্টা সত্তেও অর্ধেকের বেশি শিশু টিকা কর্মসূচির বাইরে রয়ে গেছে। আর টিকাবিহীন এই শিশুরা রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশের অন্য শিশুদের জন্য ঝুঁকি হয়ে থাকবে। টিকা না দেওয়ায় ২০১৮ সালে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে হাম ও ডিপথেরিয়া ছড়িয়ে পড়েছিল।
শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের (আরআরআরসি) সূত্র জানায়, রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে জন্মহার ৩ দশমিক ৫ শতাংশ যা বাংলাদেশের দ্বিগুণেরও বেশি। বাংলাদেশে এই হার এক দশমিক ৭২ শতাংশ।
জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) সূত্র জানায়, ২০১৭ সালে ২৫ আগস্ট থেকে পরবর্তী স্বল্প সময়ের মধ্যে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ থেকে বাংলাদেশে আসে। ওই সময় আসা নারীদের ৩০ হাজারের বেশি ছিল অন্তঃসত্ত্বা। পরবর্তী কয়েক মাসের মধ্যেই এসব সন্তান ভূমিষ্ট হয়। ইউএনএফপিএর আরেকটি তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, ৩০ হাজার অন্তঃসত্ত্বা মহিলা বাংলাদেশে এলেও শিবিরগুলোতে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে পরিচালিত সেবাকেন্দ্রগুলোতে মাত্র ৪ হাজার শিশুর জন্ম হয়। অবশিষ্ট শিশুর জন্ম হয় শিবিরে।
এতো কম সংখ্যক প্রসূতির সেবাকেন্দ্রে আসার কারণ জানতে চাইলে উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. রঞ্জন বড়–য়া আমাদের সময়কে বলেন, বেশিরভাগ রোহিঙ্গা প্রসূতি ঘরেই বাচ্চা প্রসব করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তিনি বলেন, শুধু এই একটি কারণে বাংলাদেশে কত সংখ্যক রোহিঙ্গা শিশুর জন্ম হয়েছে তা সঠিকভাবে বলা কঠিন।
রোহিঙ্গা শিবিরে কর্মরত সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা ও রোহিঙ্গা দলপতিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রোহিঙ্গাদের আগ্রহ নেই। শিশুদের টিকা দেওয়ার ব্যাপারেও তাদের অনাগ্রহ চরম। যে কোনো ধরনের ইনজেকশন দেওয়া থেকে শুরু করে ওষুধ সেবনকে তারা সন্দেহ করে জন্মনিয়ন্ত্রণের কৌশল হিসেবে। এক্ষেত্রে মহিলা ও শিশুদের ঘরের পুরুষ ও মসজিদের মৌলভীদের কঠিন বাধার মুখে পড়তে হয়। তাই অপারগ না হলে রোহিঙ্গা নারীরা চিকিৎসা ও সেবাকেন্দ্রে আসেন না। কুসংস্কার দূর করতে তিনবছর ধরে জাতিসংঘ, বাংলাদেশ সরকার ও বিভিন্ন বেসরকারি কর্মকর্তারা চেষ্টা চালিয়েও খুব একটা সফল হতে পারেননি।
উখিয়া কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের মৌলভী নুর হোসেন বিভিন্ন সময় শরণার্র্থীদের মাঝি (দলপতি), ইমাম ও সমাবেশ আয়োজনের দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে আছেন স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে। প্রভাবশালী এই ব্যক্তি জনসংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়ে বলেন, যিনি (স্রষ্টা) দেওয়ার তিনি সন্তান দিচ্ছেন। অনেকের উঠান ভরে যাচ্ছে। অনেকে চেয়েও পাচ্ছে না। এটা নিয়ে আমাদের মধ্যে কোনো চিন্তা নেই। বাংলাদেশ সরকার কিংবা কোনো এনজিও এ ব্যাপারে আমাকে কিছু বলে না।
শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের (আরআরআরসি) স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান সমন্বয়ক ডা. তোহা ভূঁইয়া আমাদের সময়কে বলেন, প্রথম দেড় বছর আমরা তাদের জন্মহার নিয়ে চিন্তা করারই সুযোগ পাইনি। আমরা শিশুমৃত্যু ঠেকাতেই বেশি ব্যস্ত ছিলাম। কারণ তাদের জন্মহার যেমন বেশি, তেমনি মৃত্যুহারও বেশি। ২০১৯ সালের মাঝামাঝি এসে তাদের টিকার আওতায় আনতে সক্ষম হই। এর পরও এ হার মাত্র ৪৭ শতাংশ। তিনি বলেন, রোহিঙ্গারা আসার সময় ৩০ হাজার নারী অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। এর পর প্রতিবছর গড়ে ২৫ থেকে ৩০ হাজার শিশু জন্ম নিচ্ছে।
বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী আছে। এর বাইরে ১৯৯১ সাল ও পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে আসা আরও এক লাখের মতো শরণার্থী নতুন ও পুরনো শরণার্থী শিবিরে আশ্রয়ে আছে। আরআরআরসির সহকারী স্বাস্থ্য সমন্বয়কারী ডা. সরওয়ার জাহান আমাদের সময়কে বলেন, গত তিন বছরে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোতে প্রায় এক লাখ শিশুর জন্ম হয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি রোহিঙ্গা শিশুদের পুরোপুরি টিকার আওতায় আনতে। তিনি বলেন, ২০১৮ সালে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে ডিপথেরিয়া ও হামের প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল। এ ধরনের রোগ ছড়ানো বন্ধ করতে টিকার বিকল্প নেই। আমরা তাই টিকা দেওয়ার জন্য তাদের উৎসাহিত করছি। বিভিন্ন সংস্থা কাউন্সেলিং করছে।
বেসরকারি সংস্থা ইপসার হেব অব রোহিঙ্গা রেসপন্স প্রোগ্রামের প্রধান মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, রোহিঙ্গাদের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি নিয়ে আজ হোক, কাল হোক ভাবতেই হবে। এটা করতে হলে তাদের মধ্যে ব্যাপক সচেতনতা দরকার। পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম শুরু করতে হলে নারীর পাশাপাশি পুরুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে।
Leave a Reply